এক মন্ত্রীর আবেদন বাতিল, অন্যজনের স্বীকৃতি প্রশ্নবিদ্ধ

বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি

এক মন্ত্রীর আবেদন বাতিল, অন্যজনের স্বীকৃতি প্রশ্নবিদ্ধ

মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ও সাংসদ ফারুক খানকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেওয়া স্বীকৃতি আবার যাচাই করবে জামুকা।

রোজিনা ইসলাম

ঢাকা

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২২, ১০: ৪৭

 

অ+অ-

 

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লেখাতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দুজন মন্ত্রী গত বছর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) আবেদন করেছিলেন। জামুকা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে বীর মুক্তিযোদ্ধার ‘স্বীকৃতি’ দিয়েছে। অন্যদিকে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যে আবেদন জামুকার কাছে করেছিলেন, যাচাই–বাছাইয়ের পর তা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই–বাছাই ও তালিকা প্রণয়নের কাজটি জামুকার মাধ্যমে হয়। গত বছরের ১৫ জুন জামুকার ৭৫তম সভায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাঁর জন্ম ১৯৬২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। সে হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় তাঁর বয়স ১০ বছরের কম ছিল। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে ন্যূনতম বয়স কত হবে, তা নির্ধারণ করা আছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত কারও বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস না হলে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হবে না।

রেজাউল করিমকে কীভাবে এ স্বীকৃতি দেওয়া হলো, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠার পর বিষয়টি নতুন করে যাচাই–বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামুকা। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জামুকার বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে কমিটি তাঁর সঙ্গে কথা বলারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বর্তমানে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছেন। দুই ঈদে ১০ হাজার টাকা করে ২০ হাজার টাকা, পাঁচ হাজার টাকা বিজয় দিবসের ভাতা এবং দুই হাজার টাকা বাংলা নববর্ষ ভাতা পান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বছরে একজন সব মিলিয়ে ভাতা পান প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে আবেদনকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ দুজন সাংসদও রয়েছেন। তাঁরা হলেন গোপালগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান এবং ঢাকা-১১ আসনের সাংসদ এ কে এম রহমতুল্লাহ। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা মিয়া তাঁর প্রয়াত বাবা সোহরাব হোসেনের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে আবেদন করেছেন। এই তিনজনের মধ্যে ফারুক খানের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত করতে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জামুকার ৭২তম সভায় সিদ্ধান্ত হয়। তবে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এখন জামুকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রকৃত সত্য উদ্‌ঘাটনের স্বার্থে ফারুক খানের বিষয়ে সেনাসদরের মতামত নেওয়া হবে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জামুকার বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।

জামুকা সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাঁর নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির জন্য যে আবেদনটি করেন, তার ওপর গত বছরের অক্টোবরে জামুকার ৭৭তম বৈঠকে পর্যালোচনা হয়। আবেদনে বলা হয়, তিনি ১৯৭১ সালে সিরাজগঞ্জ জেলায় অবস্থান করে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ আবেদনের সঙ্গে তিনজন সহযোদ্ধার প্রত্যয়নও যুক্ত করা হয়। ওই বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের আবেদনটি জামুকার বিশেষ উপকমিটিতে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। আবেদনটি পর্যালোচনা করে উপকমিটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে তিনি ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণিত নন’। উল্লেখ্য, অর্থমন্ত্রীর জন্ম ১৯৪৭ সালে কুমিল্লার লালমাই উপজেলার বাগমারা ইউনিয়নে।

একই উপকমিটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব খাজা মিয়ার বাবা সোহরাব হোসেনকেও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ৩ জানুয়ারি এ পর্যবেক্ষণে সই করেছেন বিশেষ উপকমিটির সভাপতি ও জামুকার সদস্য সাংসদ মোতাহার হোসেন, জামুকার সদস্য সাংসদ শহীদুজ্জামান সরকার এবং জামুকার আরেক সদস্য মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক।

উপকমিটির এ পর্যবেক্ষণের বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য জানতে গত রাতে মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেছে প্রথম আলো। তবে তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দুই মন্ত্রী ও সাংসদের আবেদনের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক (পদাধিকারবলে জামুকার চেয়ারম্যানও) প্রথম আলোকে বলেন, প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খানের মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্তির বিষয়ে জামুকার সুপারিশের বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন অনেকে। এ জন্য তাঁদের বিষয়ে আরেকটু যাচাই–বাছাই করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর অর্থমন্ত্রীর আবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘উপকমিটি যাচাই–বাছাই করে যা পেয়েছে, তাই বলেছে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন, এটা তারা আমাকে জানিয়েছে। আর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিবের বাবার বিষয়ে দুবার আবেদন করলেও মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সত্যতা না পাওয়ায় তাঁকে গেজেটভুক্ত করা হয়নি। আবেদন নামঞ্জুর করা হয়েছে।’

এদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য সাংসদ এ কে এম রহমতুল্লাহর আবেদনটি গত বছরের আগস্টে জামুকার ৭৬তম বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। জামুকা নথিপত্র যাচাই করে দেখেছে, আবেদনে সাংসদ নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করার জন্য লাল মুক্তিবার্তার যে নম্বর দিয়েছেন, তা সঠিক নয়। তবে জামুকার চেয়ারম্যান আ ক ম মোজাম্মেল হক ওই বৈঠকের কার্যপত্রে মন্তব্য করেছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এ কে এম রহমতুল্লাহর ‍‘স্বীকৃতি প্রাপ্য’। পরে তাঁর আবেদনটি জামুকার বিশেষ উপকমিটিতে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। উপকমিটিতে এ নিয়ে নতুন করে এখনো আলোচনা হয়নি।

মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি

জামুকা সূত্র জানায়, গত ৫০ বছরে অন্তত সাতবার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। আর মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১১ বার।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের বিষয়ে সরকার বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি দিলেও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি। এখন নতুন প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, ২৬ মার্চের মধ্য চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ২৬ মার্চ প্রায় ১ লাখ ৭৭ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার নামের সমন্বিত তালিকা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। যাঁদের ব্যাপারে জেলা-উপজেলায় তদন্ত কার্যক্রম চলছে, তাঁরা এ তালিকা থেকে আপাতত বাদ থাকবেন। আগে ১ লাখ ৯৫ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে মাসে ভাতা পাঠানো হতো। ভাতা পাওয়া সব বীর মুক্তিযোদ্ধার পূর্ণাঙ্গ তথ্য সরকার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামে একটি সফটওয়্যারে যুক্ত করার পর এ সংখ্যা অনেক কমে এসেছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকেরা বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই সরকার নিজের লোকদের সুবিধা দিতে এসব পরিবর্তন করেছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া গেলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়া যায়। এর সঙ্গে গত কয়েক বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সুবিধাও সরকার বাড়িয়েছে।

সব ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের আগে ‘বীর’ শব্দ ব্যবহারের বিধান করে ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এ ছাড়া ২০১২ সালে সরকার এক আদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের ক্ষেত্রে অবসরের বয়স ৬০ বছর করে। এমনিতে সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরে যাওয়ার বয়স ৫৯ বছর।

জামুকা সূত্র জানায়, সরকারি চাকরিতে এক বছরের বাড়তি সুবিধা পাওয়ার বিধান যুক্ত হওয়ার পরই মূলত বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা আবেদন করতে থাকেন। তবে মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেলেও পরে যাচাই–বাছাইয়ে ২০১৪ সালে চাকরিতে থাকা অবস্থায় চার সচিব ও একজন যুগ্ম সচিবের আবেদন বাতিল করা হয়।

বর্তমানে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছেন। দুই ঈদে ১০ হাজার টাকা করে ২০ হাজার টাকা, পাঁচ হাজার টাকা বিজয় দিবসের ভাতা এবং দুই হাজার টাকা বাংলা নববর্ষ ভাতা পান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বছরে একজন সব মিলিয়ে ভাতা পান প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

ক্ষমতাবান যে কেউ এখন কারসাজি করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লেখাতে পারছেন, এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। গতকাল রাতে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও প্রভাব খাটিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা করেন বা তালিকায় নাম ওঠান, তাঁদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের একজনও যাতে সরকারের তালিকা থেকে বাদ না যায়, সে উদ্যোগ থাকতে হবে জামুকা ও মন্ত্রণালয়ের।